সকল খবর ভূমি বিষয়ক খবর

জমির সঠিক কাগজপত্র থাকলে দখল না থাকলেও নামজারি বাতিল করা যাবে না!

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু

প্রকাশ : ২১-৭-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০১৮

বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে জটিলতা, অনিয়ম ও দালালচক্রের প্রভাব থাকায় প্রকৃত মালিকরাও বহু ক্ষেত্রে নিজের জমির বৈধ মালিকানা নিশ্চিত করতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায়, কারো নামে সঠিক দলিল, রেকর্ড, খাজনার রশিদ, দাতা ও গ্রহীতার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র জমি ভোগদখলে নেই এই অজুহাতে সংশ্লিষ্ট নামজারি বা মিউটেশন আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়। এটি শুধু একটি অযৌক্তিক ও অবৈধ ভূমি প্রশাসনিক অভ্যাস নয়, বরং আইন পরিপন্থীও বটে।

মিউটেশন বা নামজারি কী?
মিউটেশন বা নামজারি হলো সরকারি রেকর্ডে (Record of Rights) কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। কোনো ব্যক্তি জমি কেনার পর সেই জমির ওপর কর পরিশোধের ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির উদ্দেশ্যে নামজারি আবেদন করেন। এটি জমির মালিকানা হস্তান্তরের জন্য নয়, বরং মালিকানা ট্রান্সফারের পরের ধাপ, যাতে সরকার ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করতে পারে এবং নাগরিকের আইনি স্বত্ব নিশ্চিত হয়।

মিউটেশন আইন ও বিধান; বর্তমানে মিউটেশন সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয় ১৯৫০ সালের State Acquisition and Tenancy Act (SAT Act) এর আওতায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিধিমালায় নির্ধারিত নির্দেশনা অনুসারে। সেই সঙ্গে, ই-নামজারি বিধিমালা, ২০২১ এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পরিপত্র ও বিজ্ঞপ্তিও কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা ও বিধি অনুযায়ী, মিউটেশন কর্তৃপক্ষের কাজ হলো আবেদনকারীর জমির মালিকানা দলিল যাচাই করে তা রেকর্ডভুক্ত করা। এখানে “ভোগদখল” কোনো প্রাথমিক বা একমাত্র শর্ত নয়। বরং যিনি সঠিকভাবে দলিলপত্র, রেজিস্ট্রি কাগজ, পূর্বের রেকর্ড, খাজনার রশিদ উপস্থাপন করতে পারবেন এবং মালিকানা প্রমাণ করতে পারবেন, তাঁর পক্ষেই নামজারি করা আবশ্যক।

সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টান্ত ও আইনি ব্যাখ্যা; বাংলাদেশের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ একাধিক মামলায় স্পষ্ট করেছেন যে, ভূমি দখল না থাকাই যদি মিউটেশন বাতিলের ভিত্তি হয়, তবে তা আইন ও ন্যায়ের পরিপন্থী। জমির মালিকানা নির্ধারণ হয় মূলত দলিল ও রেকর্ডের ভিত্তিতে, দখল তার অনুষঙ্গ মাত্র। এমনকি কোনো কারণে জমি কেউ জোরপূর্বক দখলে রেখেছে, তবুও মালিকের নামে নামজারি হওয়া থেকে রোধ করা যাবে না।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি রায় হলো: “মিউটেশন অফিসার কোনো মামলার বিচারক নন; তাঁরা মালিকানার সত্যতা যাচাই করে রেকর্ড হালনাগাদ করবেন।” -এই রায়ের আলোকে স্পষ্ট যে, তারা দখলের ভিত্তিতে আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না।

নিচে "জমির সঠিক কাগজপত্র থাকলে জমি দখলে নেই বলে নামজারি খারিজের আবেদন বাতিল করা যাবে না" এই নীতির আলোকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণযোগ্য নজির, ডিসিশন, এবং DLR (Dhaka Law Reports) কেস কোড তুলে ধরা হলো, যেগুলো মিউটেশনের আইনি ভিত্তি ব্যাখ্যা করে:

মিউটেশন (নামজারি) একটি রাজস্ব প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, মালিকানার ঘোষণামূলক নয়, বরং মালিকানার ভিত্তিতে নামজারি হয়। দখলের অনুপস্থিতি একমাত্র কারণ হতে পারে না নামজারি বাতিলের জন্য।

 প্রমাণ ও নজীরসমূহ:
1. DLR 46 DLR (AD) 154
ফ্যাক্টস:
দলিল সঠিক ছিল, তবে আবেদনকারী জমিতে বাস্তবে দখলে ছিলেন না। নিচের কোর্ট নামজারি বাতিল করে।
রুলিং (আপিল বিভাগ):

“মালিকানা সঠিক দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে, দখলের অনুপস্থিতি নামজারির আবেদন বাতিলের ভিত্তি হতে পারে না।”
 “Mutation is for fiscal purpose only; it does not create title.”

2. 52 DLR (HCD) 556
বিষয়: নামজারির আবেদন খারিজ করা হয়েছিল দখলের অভাবে।
আদেশ:
“প্রকৃত মালিক দখলে না থাকলেও, যদি যথাযথ রেজিস্টার্ড দলিল থাকে, তাহলেও নামজারি হতে বাধা নেই।”
 “Registered deed has presumption of correctness unless rebutted.”

3. 14 BLD (HCD) 293
বিষয়: দখল ছাড়া নামজারি হবে না মর্মে রাজস্ব কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত।
রায়:
“দখলের ভিত্তিতে নামজারি না করার সিদ্ধান্ত ভুল; মালিকানার দলিলই যথেষ্ট।"

4. 18 MLR (HCD) 145
বিষয়: উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিতে দখলে না থাকায় নামজারি বাতিল করা হয়।
রুলিং:
 “দখল না থাকা উত্তরাধিকারকে নামজারি থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।”

5. 65 DLR (HCD) 89
বিষয়: একই জমির উপর একজন দখলে থাকলেও, বৈধ দলিলধারী ব্যক্তিকে নামজারিতে অস্বীকৃতি।
আদেশ:
“Mutation must follow the lawful title, not mere physical possession.”

মিউটেশন আইন ও বিধি অনুসারে ব্যাখ্যা:

ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০১৫
ধারা ২৪ ও ২৫:
হোল্ডিং খোলা ও নামজারির জন্য ভূমি মালিকানার যথাযথ দলিল থাকতে হবে।

Mutation Manual (ভূমি ম্যানুয়াল)
চ্যাপ্টার ৫ ও ৭:
দলিল যাচাই করে যদি কাগজপত্র সঠিক থাকে, তাহলে দখলের অবস্থা না দেখেও নামজারি করা যাবে।

ভূমি উন্নয়ন কর এবং হোল্ডিং খোলা- যখন প্রকৃত মালিকের নামে মিউটেশন সম্পন্ন হয়, তখন ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট হোল্ডিং নম্বর খোলা হয়। এতে রাজস্ব বিভাগের আয় বাড়ে এবং রাষ্ট্র একটি সুশৃঙ্খল রেকর্ড ব্যবস্থার আওতায় ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।

অন্যদিকে, মিউটেশন না হওয়ায় একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারায়, তেমনি প্রকৃত মালিক সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন। কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বা ব্যাংক লোন কিংবা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় মিউটেশন না থাকলে অনেক বাধা তৈরি হয়।

দখল না থাকা মানে মালিকানা নেই;  এই ধারণা ভুল- ভূমি প্রশাসনের একটি প্রচলিত ভুল হলো, “দখলই মালিকানা”। অথচ এটি আইনি দৃষ্টিতে পরিপূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশে অসংখ্য জমি আছে যেগুলো প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিতে অন্যরা দখলে রেখেছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে দখলদাররা জাল দলিল বা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নিজেদের পক্ষে অবৈধ মিউটেশন করিয়েও নেয়।

এইসব ক্ষেত্রে দলিল, রেকর্ড এবং অন্যান্য বৈধ কাগজপত্র যদি প্রকৃত মালিক পেশ করেন, তবে তা যাচাই করে তৎক্ষণাৎ তাঁর নামে নামজারি সম্পন্ন করতে হবে। জমি বর্তমানে কার দখলে আছে তা নয়, কার দলিল সঠিক সেটিই আসল বিবেচ্য।

সাম্প্রতিক মিউটেশন প্রক্রিয়ার সংস্কার; ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চালু হয়েছে ই-নামজারি পদ্ধতি, যা দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল দক্ষতা এনেছে। এখন আবেদনকারী নিজেই অনলাইনে আবেদন করতে পারেন এবং আবেদনপত্র, দলিলপত্র স্ক্যান করে দাখিল করতে পারেন। নিয়োজিত সহকারী কমিশনার (ভূমি) নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুনানি শেষে রায় দেন।

ই-নামজারির প্রক্রিয়ায়ও অনেক ক্ষেত্রে এখনও দখল না থাকার অজুহাতে আবেদন বাতিলের ঘটনা ঘটে। অথচ, এটি নতুন ডিজিটাল কাঠামোর উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা ও কঠোর নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে।

মিউটেশন না করলে কী হয়?
১. হোল্ডিং না খোলায় ভূমি কর আদায় সম্ভব হয় না।
২. বিক্রি, হস্তান্তর বা উত্তরাধিকার প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়।
৩. প্রকৃত মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হন, জালিয়াতরা সুযোগ নেয়।
৪. রাষ্ট্র রাজস্ব হারায়, ডিজিটাল রেকর্ড সঠিকভাবে হালনাগাদ হয় না।
৫. মামলা-মোকদ্দমা বাড়ে, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়।

জমির মালিকানা নির্ধারণে দখলের চেয়ে দলিল ও রেকর্ডই মূল ভিত্তি। মিউটেশন একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া মাত্র- কোনো রায় বা আদালতের সিদ্ধান্ত নয়। অতএব, জমির প্রকৃত মালিক সঠিক কাগজপত্র উপস্থাপন করলে, তাঁর নামে নামজারি বাধাহীনভাবে সম্পন্ন করতে হবে। রাষ্ট্রের উচিত হবে এই প্রক্রিয়াকে দখল নির্ভর না করে দলিল নির্ভর করে তোলা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে প্রতিটি মিউটেশন কার্যক্রমে আইন অনুসরণ নিশ্চিত করা।

জমি যার, খাজনাও তার;  এই মূলনীতির বাস্তবায়নেই গড়ে উঠবে ডিজিটাল, স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক ভূমি প্রশাসন।