সকল খবর ভূমি বিষয়ক খবর

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩: ন্যায়বিচার ও সুশাসনের নতুন দিগন্ত

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু

প্রকাশ : ২১-৭-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৭৪

বাংলাদেশে ভূমি সম্পর্কিত বিরোধ ও অপরাধ বহু পুরোনো সামাজিক ও প্রশাসনিক সংকট। ‘জমি’ কেবল অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, সামাজিক মর্যাদা, বসবাসের নিরাপত্তা, এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপত্তির উৎস হিসেবেও কাজ করে। ফলে ভূমি নিয়ে বিরোধ, প্রতারণা, দখল ও সহিংসতা দেশের গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত একটি সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু মানুষ জমির বৈধ কাগজ থাকা সত্ত্বেও জমির দখল ফিরে পান না, আবার অনেকেই বছরের পর বছর অন্যের জমি দখল করে রেখেও আইনানুগভাবে মালিকানা দাবি করেন। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ২০২৩ সালে পাস করে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩’। এ আইনটি ভূমি খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই আইন অনুসারে, কারো জমির বৈধ কাগজপত্র না থাকলে, তা দীর্ঘদিন দখলে থাকলেও মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে না। আবার জাল বা মিথ্যা দলিল তৈরি করে জমির দখল নিলে, বৈধ মালিককে জমিতে প্রবেশে বাধা দিলে কিংবা ভয়ভীতি দেখালে তা ‘ভূমি অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হবে। এক কথায়, আইনটি একটি মৌলিক বার্তা দিয়েছে—ভূমির মালিকানা নির্ভর করবে বৈধ কাগজপত্রের ওপর, দখলের ওপর নয়।

এই আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকেই সমাজে একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছেছে যে, জমি দখল করে, জাল দলিল তৈরি করে বা প্রভাব খাটিয়ে কারো জমি আত্মসাৎ করার দিন শেষ। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে আইনের বাস্তবায়ন, জনগণের সচেতনতা, এবং প্রশাসনিক সদিচ্ছা ছাড়া এই আইন কতটা কার্যকর হবে, সে প্রশ্ন এখন সময়ের দাবি।

আইনটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। প্রথমত, আইনটি ‘ভূমি অপরাধ’কে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। জমির মালিকানা সম্পর্কিত জাল কাগজ তৈরি, জাল দলিল ব্যবহার, ভুয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তৈরি, কোর্টের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জমিতে ঢোকা বা নির্মাণ কার্যক্রম চালানো, কিংবা বৈধ মালিককে ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি থেকে সরিয়ে দেওয়া—এসবই এখন ফৌজদারি অপরাধ। এমনকি অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করলেও দায় থেকে মুক্তি নেই।

দ্বিতীয়ত, আইনটি শুধু শাস্তির ব্যবস্থাই করে না, বরং ক্ষতিগ্রস্তকে প্রতিকার পাওয়ারও সুযোগ দেয়। কেউ যদি বৈধ মালিক হয়েও জমির দখল না পান, তিনি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবেন। জেলা প্রশাসক তদন্ত করে সত্যতা পেলে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদের উদ্যোগ নিতে পারবেন, প্রয়োজনে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবহার করে।

তৃতীয়ত, আইনটি স্থানীয় প্রশাসন ও ভূমি অফিসের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা তৈরি করেছে। ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস কিংবা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের ভূমি হস্তান্তর বা নামজারি করার আগে জমির কাগজপত্র যাচাই করতে বাধ্য করা হয়েছে। কেবল দখলের ভিত্তিতে নামজারি বা খতিয়ান তৈরি করা যাবে না। এতে জাল দলিল তৈরি করে মালিকানা বদলের প্রবণতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।

তবে আইনটি বাস্তবায়নে কিছু মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় জমির সঠিক রেকর্ড এখনো হালনাগাদ হয়নি। বহু পুরনো আরএস, বিএস, সিএস, এসএ পর্চার ভিত্তিতে জমির মালিকানা নির্ধারণ করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আবার অনেক সময় ভূমি অফিসে জাল দলিলপত্র তৈরি হয় দুর্নীতির মাধ্যমে। ফলে এই আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রথমে ভূমি ব্যবস্থার ডিজিটাল রেকর্ড ও একক খতিয়ান চালু করা প্রয়োজন।

এছাড়া, এক শ্রেণির দখলদার বহু বছর ধরে জমি ব্যবহার করে আসছেন, তারা নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে দলিলও করে ফেলেছেন বা দলিল বিহীনভাবে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছেন। এদের উচ্ছেদ করতে গেলে সামাজিক ও মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে। আইন বলছে, যতদিনই জমি দখলে থাকুক না কেন, বৈধ মালিক ছাড়া অন্য কেউ মালিক হতে পারে না। তবে এটি বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন, বিশেষ করে যখন দখলদাররা স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকেন।

আরেকটি সমস্যা হলো আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের বৈচিত্র্য। অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসন বা থানা ‘দখল আছে’—এই যুক্তিতে বৈধ মালিকের পক্ষ না নিয়ে দখলদারের পক্ষ নেয়। ভূমি সংক্রান্ত মামলা থানায় গেলে পুলিশ অভিযোগ না নিয়ে 'দেখছি', 'কোর্টে যান', এমন অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। নতুন আইনের আলোকে পুলিশের ভূমি অপরাধ নিয়ে দায়িত্বশীল হওয়া অপরিহার্য।

আইনটি প্রয়োগে নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব রক্ষা না হলে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রয়োজনে একটি স্বাধীন ভূমি অপরাধ তদন্ত সংস্থা গঠন করা যেতে পারে যারা সরাসরি ভূমি অপরাধের তদন্ত করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে পারবে।

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে নাগরিক সমাজকেও। গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা ও আইনজীবীরা ভূমি অপরাধের শিকার মানুষদের পাশে দাঁড়ালে আইনের প্রতি আস্থা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধের তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ, ভুক্তভোগীদের সহায়তা প্রদান এবং আইনি পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী সামাজিক কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই আইন শুধু শহরাঞ্চলে নয়, গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের জন্যও এক বড় আশার আলো। জমির কাগজ হারিয়ে গেছে কিংবা বিভ্রান্তিকর খতিয়ান থাকায় বহু মানুষ আইনের আশ্রয় নিতে ভয় পান। এখন নির্ভরযোগ্য রেকর্ড সিস্টেম ও সহজ বিচার প্রক্রিয়া চালু হলে গ্রামীণ বিরোধের সংখ্যা হ্রাস পাবে।

আইনটির একটি দুর্বলতা হিসেবে বলা যায়, প্রতিটি অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য অনেক সময় প্রয়োজন হয়, যেখানে জমির দখল ফিরে পাওয়ার আগেই নানা জটিলতা তৈরি হয়। যদিও আইনটি ‘দ্রুত প্রতিকার’-এর কথা বলেছে, তবু জেলা প্রশাসকের ওপর অতিরিক্ত দায় চাপিয়ে দিলে প্রকৃত অর্থে তা কার্যকর হতে সময় লাগবে। এখানেই প্রযুক্তিনির্ভর ভূমি প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

এ ছাড়াও প্রয়োজন একটি কেন্দ্রীয় অভিযোগ রেজিস্ট্রেশন ও ট্র্যাকিং সিস্টেম, যেখানে প্রতিটি জমি অপরাধের অভিযোগ, অগ্রগতি ও নিষ্পত্তি সম্পর্কে তথ্য থাকবে। এমন একটি ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু হলে সাধারণ মানুষ অভিযোগের ফলাফল জানতে পারবেন এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা বাড়বে।

সবশেষে বলা যায়, ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩’ একটি যুগোপযোগী আইন, যা বাংলাদেশের জমি ব্যবস্থাকে আরও সুশৃঙ্খল ও ন্যায্য করতে পারে। তবে এর সাফল্য নির্ভর করছে আইনের বাস্তবায়ন, জনগণের সচেতনতা, প্রশাসনের আন্তরিকতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর। জমি নিয়ে অনিয়ম, জালিয়াতি ও দখলের সংস্কৃতি ভাঙতে হলে এই আইনকে কার্যকর করতে হবে শক্ত হাতে, মানবিক বিবেচনায় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাপকাঠিতে। তাহলেই এই আইনের মাধ্যমে দেশের ভূমি খাতে ন্যায়বিচার ও সুশাসনের ভিত্তি তৈরি হবে।