দেশের স্বাস্থ্য খাত বর্তমানে অর্থসংকটে পড়েছে, যার ফলে গত ৯ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে ৩৪টি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কর্মসূচি। পাঁচ বছর মেয়াদি অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) চালু না থাকার কারণে এই কর্মসূচিগুলো স্থগিত হয়ে গেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, বিকল্প চিকিৎসা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, ওষুধ সরবরাহসহ নানা জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম।
সম্প্রতি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে দুই বছরের প্রকল্প প্রণয়নের জন্য, যার ফলে পাঁচ বছর মেয়াদি অপারেশনাল প্ল্যান বাতিল করা হয়েছে। তবে, এই সিদ্ধান্তে স্বাস্থ্য সেক্টরে গুরুতর সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলেছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে জাতীয় স্বাস্থ্য সিস্টেম ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়তে পারে, যা শুধু স্বাস্থ্য সেবায় ব্যাঘাত ঘটাবে না, বরং দীর্ঘদিনে অর্জিত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সফলতা হারাতে পারে। এমনকি, যেসব রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল, সেগুলো আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে।
দেশের প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ, যার ফলে মজুদ থাকা ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, হেপাটাইটিস, ডেঙ্গু, এইডস, জলাতঙ্ক এবং যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এখন স্থগিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. হালিমুর রশিদ কালের কণ্ঠকে জানান, ‘৩৪টি অপারেশনাল প্ল্যানের মধ্যে ১০টি রোগ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কর্মসূচি রয়েছে, যেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কর্মসূচি চলতে থাকলে দেশের অনেক রোগ নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু বন্ধ থাকলে সেগুলো আবারও বৃদ্ধি পাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে কিছু রোগ নির্মূল হয়েছে এবং কিছু রোগ কমে আসছিল, কিন্তু এইভাবে কর্মসূচি বন্ধ থাকলে এসব রোগের আবারও বিস্তার হবে। সরকারের উচিত, অন্য কোনো ব্যবস্থা নিয়ে হলেও এই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন, পাশাপাশি অপচয় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে অপারেশনাল প্ল্যানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা জরুরি।
এছাড়া, স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কমিউনিটি বেইজড হেলথকেয়ার (সিবিএইচসি), সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাপনা, হাসপাতাল সেবা, মাতৃ, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্যসেবা, সম্প্রসারিত টিকা কার্যক্রম (ইপিআই), জাতীয় চক্ষুসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, গবেষণা, ক্রয়, মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এসব কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট শাখা জানিয়েছে, অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়। এর আওতায় সব জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা যন্ত্রাংশ, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম এবং অন্যান্য উপকরণের শতভাগ অর্থায়ন নির্ভরশীল। কিন্তু ওপি না থাকায় এসব কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আগে যে স্বাস্থ্য কার্যক্রমে সফলতা পেয়েছি, সেগুলো হারানোর আশঙ্কা এখন বাড়ছে। আমাদের উচিত, জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অব্যাহত রাখা।’
এ অবস্থায়, সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্বাস্থ্য সেক্টরের এসব কার্যক্রম চালু রাখা এবং স্বাস্থ্য খাতে আরও বিনিয়োগ করা, যাতে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে।