অন্যান্য খবর অর্থনীতি

বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের খাতসমূহ: উৎস, সম্ভাবনা ও কর ব্যবস্থার উন্নয়ন ভাবনা

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু

প্রকাশ : ১৪-৭-২০২৫ ইং | নিউজটি দেখেছেনঃ ৫০৩৪

রাজস্ব একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন কাঠামোর মেরুদণ্ড। একটি দেশের বাজেট, অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় আবশ্যক। বাংলাদেশ, একটি উদীয়মান উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, এখনো রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা মোকাবিলা করছে। তবে বিভিন্ন কর খাত থেকে রাজস্ব আহরণ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে পথ তৈরি হয়েছে, তা যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ করলে আত্মনির্ভর রাষ্ট্রে রূপান্তর সম্ভব।

রাজস্ব আয়ের শ্রেণিবিন্যাস

বাংলাদেশের রাজস্ব আয়কে দুইটি মূল ভাগে ভাগ করা যায়; প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ কর। প্রত্যক্ষ কর হলো ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক আয়ের ওপর সরাসরি আরোপিত কর; অন্যদিকে পরোক্ষ কর হলো ভোক্তার ওপর আরোপিত কর, যা সাধারণত পণ্য ও সেবা ব্যবহারের মাধ্যমে আদায় করা হয়।

এই দুই ধারার কর মিলিয়ে বাংলাদেশ সরকার যে রাজস্ব আয় করে, তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি উৎস উল্লেখযোগ্য।

রাজস্ব আয়ের খাতসমূহ
১. মূল্য সংযোজন কর (VAT)
বর্তমানে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হলো মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। বাংলাদেশে ১৫% হারে ভ্যাট আরোপ করা হয় পণ্য ও সেবার বিভিন্ন পর্যায়ে। পণ্য উৎপাদন, পরিবহন, পাইকারি-বিক্রয় ও খুচরা পর্যায়ে ক্রেতা এই ভ্যাট প্রদান করে থাকে।

এটি একটি প্রগতিশীল পরোক্ষ কর ব্যবস্থা যা স্বচ্ছতার ওপর নির্ভরশীল। অনেক ব্যবসায়ী ভ্যাট ফাঁকি দিলেও, অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, ডিজিটাল ভ্যাট চালান ও স্বয়ংক্রিয় হিসাবব্যবস্থা চালু হলে রাজস্ব আরো বাড়ানো সম্ভব।

২. আয়কর (Income Tax)
প্রত্যক্ষ করের প্রধান উৎস হলো আয়কর। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের উপার্জনের উপর এই কর ধার্য হয়। তবে দেশের আয়কর প্রদানকারী নাগরিকের সংখ্যা এখনো আশানুরূপ নয়। লক্ষণীয় যে, একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনো করের আওতার বাইরে, বিশেষত উচ্চ আয়কারী ফ্রিল্যান্সার, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, বড় রেস্টুরেন্ট বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকার অনলাইন আয়কর রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা চালু করেছে, যা কর আদায় প্রক্রিয়াকে সহজ ও আধুনিক করেছে।

৩. আমদানি শুল্ক ও কাস্টমস ডিউটি
বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির সময় যে শুল্ক আরোপ করা হয় তা কাস্টমস ডিউটি নামে পরিচিত। বিলাসপণ্য যেমন গাড়ি, মোবাইল, প্রসাধনী, হোয়াইট গুডস ইত্যাদির ওপর শুল্কের হার তুলনামূলক বেশি। এটি সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য পরোক্ষ কর উৎস। তবে চোরাচালান, অবৈধ আমদানি এবং দুর্নীতির কারণে এই খাতের পূর্ণ সম্ভাবনা এখনো কাজে লাগানো যায়নি।

৪. উৎসে কর (Withholding Tax)
এই খাত আয়করের একটি অংশ। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন অর্থ লেনদেন করে, তখন তার একটি নির্দিষ্ট অংশ সরকার কর্তৃক ‘উৎসে কর’ হিসেবে কেটে নেওয়া হয়। জমি বিক্রি, ব্যাংক সুদ, ঠিকাদারি বিল, কোম্পানি লভ্যাংশ ইত্যাদি লেনদেনে উৎসে কর আরোপ করা হয়ে থাকে। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় কর আদায় পদ্ধতি এবং আয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর।

৫. ভূমি কর ও সম্পত্তি কর
বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে ভূমি একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তবে ভূমি করের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। কর ফাঁকি, ভূমি মালিকানার অস্পষ্টতা, ডিজিটাল রেকর্ডের অভাব এবং প্রশাসনিক দুর্নীতি এই খাতের আয়কে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। যদি সমন্বিত ভূমি তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় এবং কর আদায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে শুধু ভূমি কর থেকেই বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের সুযোগ রয়েছে।

৬. জ্বালানি ও শক্তি খাত
জ্বালানি পণ্য, যেমন ডিজেল, অকটেন, কেরোসিন, এলপিজি এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর সরকার যে কর আরোপ করে, তা একটি বিশাল পরিমাণ রাজস্ব আনে। তবে কিছু পণ্যে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে, ফলে এখানকার প্রকৃত আয় তুলনামূলক সীমিত।

৭. তামাক, অ্যালকোহল ও বিলাসপণ্য কর (Sin Tax)

স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে সরকার রাজস্ব আদায় করে থাকে। সিগারেট, বিড়ি, অ্যালকোহল, কোমল পানীয়, জুতা, প্রসাধনী ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। এসব ‘সিন ট্যাক্স’ সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক।

৮. রেলপথ ও পরিবহন খাত
সরকারি রেলপথ এবং গণপরিবহনের টিকিট, মাল পরিবহন, ভাড়া ও পণ্য সার্ভিস থেকে যে আয় আসে, তা অতীতের তুলনায় অনেক কম। অপার মুনাফার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রেলওয়ে এক লোকসানী খাত হিসেবে পরিচিত। দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা এই খাতকে রাজস্বের বিরাট উৎসে পরিণত হতে দিচ্ছে না।

৯. ডাক ও টেলিযোগাযোগ খাত
ডাক বিভাগ এবং BTRC মোবাইল অপারেটরদের লাইসেন্স ফি ও স্পেকট্রাম নিলাম থেকে কিছু পরিমাণ আয় করে থাকে। যদিও ডিজিটাল যুগে ডাক বিভাগের প্রাসঙ্গিকতা কমেছে, তবে BTRC-এর মাধ্যমে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের উপর আরোপিত শুল্ক সরকারকে ভালো পরিমাণ রাজস্ব দেয়।

১০. সরকারি সম্পত্তি, ইজারা ও ফি
সরকারি স্থাপনা, জমি ও প্রকল্প ইজারা দিয়ে সরকার সীমিত পরিমাণে আয় করে। যেমন: হাট-বাজার ইজারা, জলমহাল, বাস টার্মিনাল ইত্যাদি। এসব খাতেরও সম্ভাবনা বিশাল, তবে স্থানীয় দুর্নীতির কারণে আয় সীমিত রয়ে গেছে।

রাজস্ব বাড়ানোর সম্ভাবনা ও কর ব্যবস্থার উন্নয়ন বিশ্লেষণ
বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ জাতীয় আয়ের তুলনায় এখনও কম। কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৯%–১০%, যেখানে দক্ষিণ এশীয় গড় হলো ১৫%-এর বেশি। তাই রাজস্ব বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার, প্রযুক্তি ও সচেতনতার সমন্বিত প্রয়াস।

১. করজাল সম্প্রসারণ
দেশের করদাতা সংখ্যা এখনো কম। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ট্রানজেকশন, সম্পত্তির মালিকানা, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ তথ্য ব্যবহার করে সহজেই কর ফাঁকিদের শনাক্ত করা সম্ভব। এনবিআর যদি জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে আয়কর তথ্য সংযুক্ত করে দেয়, তবে কর ফাঁকি রোধ করা যাবে।

২. ডিজিটাল কর প্রশাসন
অনলাইন কর রিটার্ন, ই-পেমেন্ট, অটোমেটেড কর পরিশোধ ব্যবস্থা চালু হলে স্বচ্ছতা আসবে এবং করদাতারা হয়রানির ভয়ে কর ফাঁকি দেবে না। জমি কর, ট্রেড লাইসেন্স, ইজারা ইত্যাদিও অনলাইনে পরিশোধযোগ্য হলে আয়ের পরিধি বাড়বে।

৩. শৃঙ্খলা ও দুর্নীতি দমন
রাজস্ব বিভাগে ঘুষ, অনিয়ম ও কমিশন বাণিজ্য বড় বাধা। এনবিআর, ভূমি অফিস, কাস্টমস ও স্থানীয় সরকার অফিসগুলোতে নজরদারি এবং স্বাধীন অডিট ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।

৪. কর সচেতনতা ও পুরস্কারভিত্তিক সংস্কৃতি

জনগণকে বোঝাতে হবে; কর দেওয়া একটি গর্বের কাজ। সৎ করদাতাকে পুরস্কৃত করলে কর প্রদানে আগ্রহ বাড়বে। পাশাপাশি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘কর শিক্ষা’ চালু করাও সময়ের দাবি।

বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থা এখনো ঘাটতির মধ্যে আবদ্ধ। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এর জন্য দরকার করজাল সম্প্রসারণ, প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছ প্রশাসন, এবং নাগরিক সচেতনতা। রাজস্ব ব্যবস্থার প্রতিটি খাতকে যদি কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ আত্মনির্ভরতার পথে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে পারবে। তখন বিদেশি ঋণের বোঝা কমবে এবং রাষ্ট্রীয় সেবার মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হবে।