টোকিও, জাপান: জাপানের রাজধানী টোকিওর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরলে সুপারশপ, রেস্টুরেন্ট, শপিং মলসহ নানা জায়গায় বাংলাদেশিদের দেখা মেলে। পড়ালেখা, চাকরি ও ব্যবসাসহ নানা পেশায় জড়িত রয়েছেন তারা। তবে বেশিরভাগ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করেন। জাপানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন স্থানীয় প্রবাসী ও বিশ্লেষকরা।
টোকিওতে অবস্থিত হোটেল ওয়াশিংটনে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে নিচে নেমে একটি সুপারশপে ঢুকেই পরিচয় হয় বাংলাদেশি দুই তরুণ-তরুণীর সঙ্গে। আলাপচারিতায় জানা যায়, জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি তারা এই সুপারশপে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। ওইদিন বিগসাইট এলাকা ঘুরে মধ্যরাতে খাবার কিনতে আরেকটি সুপারশপে গিয়ে সেখানেও দেখা মেলে এক বাংলাদেশি প্রবাসীর সঙ্গে।
এভাবে টোকিওর বিভিন্ন এলাকায় অনেক সুপারশপে বাংলাদেশি কর্মীর দেখা মেলে। তাদের বেশিরভাগই পড়ালেখার পাশাপাশি এই চাকরি করেন। তবে শুধু সুপারশপেই নয়, জাপানের বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশিরা ভালো অবস্থানে রয়েছেন।
প্রায় ৩৩ বছর ধরে জাপানে বসবাসরত প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক পি আর প্ল্যাসিড বলেন, "জাপানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং জাপানি ভাষার কোর্স করতে আসা বাংলাদেশির সংখ্যাই বেশি। তারাই এসব চাকরি করেন। তবে আইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসাসহ নানা সেক্টরে ভালো চাকরি করেন অনেকেই।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশিরা রাতারাতি বড়লোক হতে চান। এজন্য অনেক শিক্ষার্থী নিয়ম ভঙ্গ করে দিনে একটা, রাতে আরেকটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। যার কারণে ক্লাসে গিয়ে অনেকেই ঝিমান। ঠিকমতো পড়ালেখা শেষ করতে না পারার কারণে ভালো চাকরি জোটে কম। বেশিরভাগেরই বড় স্বপ্ন নেই। অথচ অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা জাপানে ‘অড জব’ করেন খুবই কম। ভালো অবস্থানে যাওয়ার জন্য তাদের বেশিরভাগই দক্ষতা অর্জন করেন, পরিশ্রম করেন। আর বাঙালিরা জাপানে এসেই টাকার পেছনে ছুটতে থাকেন।"
জাপানে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে স্থানীয় নাগরিকদের মূল্যায়ন সম্পর্কে প্ল্যাসিড বলেন, "বাংলাদেশকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছে জাপান। কিন্তু কিছুসংখ্যক বাঙালির মিথ্যা বলা, নারীদের উত্ত্যক্ত করাসহ ছোটখাটো অপরাধের কারণে আমাদের ইমেজ কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। অনেক বাঙালি জাপানি ব্যবসায়ীদের ব্যবসার নামে ফুসলিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে সর্বস্বান্ত করার কারণে কেউ কেউ নতুন করে বিনিয়োগে অনেক হিসাব করেন।"
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত জাপানে বসবাসকারী বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল প্রায় ২১ হাজার। গত বছরের জুনে তা বেড়ে প্রায় ২৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এ বছরের জুন শেষে সংখ্যাটি আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাপানে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ও প্রকৌশল (ইঞ্জিনিয়ারিং) খাতে চাকরির বাজার বেশ ভালো। এর পাশাপাশি জাপানি ভাষা জানা থাকলে চাকরি পেতে সহজ হয়। অনেকেই জাপানি ভাষা শিখতে সেখানে যান। সাধারণত দুই থেকে তিন বছর বা কারও কারও তারও বেশি সময় লাগে এই ভাষা শিখতে।
প্রায় ২০ বছর ধরে জাপানে বসবাস করছেন আরেক বাংলাদেশি মুস্তাফিজুর রহমান জনি। কুষ্টিয়ার এই বাসিন্দা সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি জানান, "বাংলাদেশিদের অনেকেই ব্যবসা কিংবা চাকরি করে এখানে ভালো অবস্থানে আছেন। তবে বেশিরভাগই ‘অড জব’ (নিম্নমানের চাকরি) করেন। অফিসে চেয়ার-টেবিলে বসে চাকরি কিংবা ব্যবসা করা বাংলাদেশিদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো হবে। এর মধ্যে আবার খুব ভালো অবস্থানে আছেন সেই সংখ্যা ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো হতে পারে।"
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) থেকে যন্ত্রকৌশল বিভাগ থেকে পাস করে দেশে কয়েক বছর চাকরি করেছেন প্রকৌশলী রুহুল আমিন সবুজ। তিনি ২০১২ সালে জাপানে থিতু হন। জাপানের ইবারাকি এলাকায় একটি কারখানায় চাকরি করেন তিনি।
সবুজ জানান, তার এলাকায় প্রায় ১৫০ বাংলাদেশি বসবাস করেন। বিভিন্ন উৎসবে কিংবা ছুটির দিনে মাঝেমধ্যেই একসঙ্গে মিলিত হন তারা। তিনি বলেন, "বাংলাদেশিরা যারা নিম্নপদস্থ চাকরি করেন, শুরুতে একেকজন প্রতি মাসে গড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় করতে পারেন। এর মধ্যে থাকা-খাওয়া, সরকারের বিভিন্ন ট্যাক্স ও অন্যান্য খরচই চলে যায় প্রায় অর্ধেক। তবে পরিবার নিয়ে থাকলে কিংবা সন্তানদের পড়ালেখা করাতে গেলে একজনের এই বেতনে চলা মুশকিল। অবশ্য যারা ব্যাচেলর থাকেন, তারা কষ্ট করে কিছু টাকা জমাতে পারেন।"
জাপানে ব্যবসার পরিবেশ ভালো এবং নিয়মকানুনও তুলনামূলক সহজ। সেখানে ব্যবসা করতে হলে প্রাথমিক অবস্থায় ব্যাংকে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা দেখাতে হয়। অন্যান্য শর্ত পূরণ করে ব্যবসার নিবন্ধন পাওয়ার পর সপ্তাহখানেকের মধ্যে এই টাকা আবার তুলে খরচ করা যায়। এ কারণে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসা করেন সেখানে।
কিংসিচো এলাকায় সেইয়ো নামের একটি সুপারশপে কেনাকাটা করতে গিয়ে পরিচয় হয় আদনান হাসান নিঝুম নামের এক বাংলাদেশি তরুণের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ১৮ বছর আগে তার বাবা জাপানে একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন। এরপর তার বাবা, বড় ভাই মিলে ধীরে ধীরে সেখানে চারটি রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন।
নিঝুম বলেন, "এখানকার ব্যবসার পরিবেশ খুবই ভালো। কোনো উটকো ঝামেলা নেই। একটু বুঝেশুনে ব্যবসা করতে পারলে খুব ভালো আয়-রোজগার করা সম্ভব। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের আয় খুব ভালো।"
জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশ থেকে এসে থেকে যান। আবার অনেক প্রবাসী বাঙালি নিজের ভাই কিংবা ঘনিষ্ঠ স্বজন পরিচয় দিয়ে জাপানিদের মাধ্যমে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে জাপানে নিয়ে যান অনেককে। পরে দেখা যায় ওই বাঙালি তার কাছ থেকে জাপান যেতে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। এতে অনেক বাংলাদেশি জাপানিদের আস্থা নষ্ট করেছেন।
জাপানে কঠোর নিয়মকানুন থাকায় নিয়ম ভাঙায় অভ্যস্ত বাঙালিরা সেখানে ঠিকই নিয়ম মানছেন। কাজেও ফাঁকি দেন না। তুলনামূলক বিনয়ী এবং পরোপকারী।
দাইইচি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে আইটিতে পড়ালেখা করেন ফজলুল হক রাজু নামের এক বাংলাদেশি। একটি সুপারশপে রাত সাড়ে ১২টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, দিনে ক্লাস আর রাতে ওই সুপারশপে খণ্ডকালীন চাকরি করেন তিনি। টোকিওতে থাকা-খাওয়া অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় তাকে এই কষ্ট করতে হয়।
সেভেন ইলেভেন নামে একটি সুপারশপে কথা হয় ঝিনাইদহের বাসিন্দা হাসানুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানান, জাপানি ভাষা শেখার জন্য জাপানে এসেছিলেন তিনি। দুই বছরে ভাষা শিখে এখন চাকরি করছেন। সব মিলে তিনি বেশ ভালো আছেন।
জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। সেখানে অবসরের সুযোগ তুলনামূলক কম। সেজন্য সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি আছে। বিভিন্ন উৎসব বা উপলক্ষকে ঘিরে তারা এক হয়ে আনন্দ-উল্লাস করেন। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন শিল্পী বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়েও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জাপানে বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, জাপানে বাংলাদেশিদের জন্য প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নিয়ম মেনে চলা, দক্ষতা অর্জন এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোলে তারা সেখানে ভালো অবস্থানে পৌঁছাতে পারবেন।