বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দেশের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, যানজট, পরিবেশ দূষণ ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এক পক্ষ মনে করে, রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নিলে ঢাকার উপর চাপ কমবে। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন, এটি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হবে। তাই এ বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
ঢাকার সংকট ও জনসংখ্যার চাপ
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব কর্মকাণ্ড এখানে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে আসছেন। এতে ঢাকা শহরের অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে, যানজট, বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরের বসবাসযোগ্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
অন্য দেশে রাজধানী স্থানান্তরের উদাহরণ
অনেক দেশ রাজধানী স্থানান্তরের মাধ্যমে নগর সংকট সমাধানের চেষ্টা করেছে। ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়া তাদের রাজধানী জাকার্তা থেকে বোর্নিও দ্বীপের নুসানতারায় সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে—জাকার্তার উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব, বন্যার ঝুঁকি ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়ার বিষয়টি।
মিশরও রাজধানী কায়রো থেকে ৪৫ কিলোমিটার পূর্বে একটি নতুন প্রশাসনিক শহর গড়ে তুলছে। এর মূল কারণ কায়রোর তীব্র যানজট ও প্রশাসনিক ভবনের চাপ। মিয়ানমারও ২০০৫ সালে তাদের রাজধানী ইয়াঙ্গন থেকে নেপিডোতে সরিয়ে নেয়, যা রাজনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তার কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
ঢাকার বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকার ওপর চাপ কমানোর জন্য প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হতে পারে। ঢাকার প্রশাসনিক দপ্তর, শিল্পকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো দেশের অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তর করা হলে শহরের জনসংখ্যার চাপ কমতে পারে।
সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প যেমন—মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সাবওয়ে ইত্যাদি বাস্তবায়ন করছে। তবে এগুলোর মাধ্যমে যানজট সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়, যদি না প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
নতুন রাজধানী তৈরির সম্ভাব্য ব্যয়
নতুন রাজধানী তৈরিতে বিশাল অর্থ ব্যয় হবে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইন্দোনেশিয়া ও মিশরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, নতুন শহর গড়ে তুলতে ৩০-৪৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে। বাংলাদেশে যদি নতুন রাজধানী তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তাহলে কয়েক লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ঢাকায় ইতোমধ্যে সব সরকারি দফতর, মন্ত্রণালয় ও বিদেশি দূতাবাস স্থাপিত হয়েছে। নতুন রাজধানীতে এগুলো স্থানান্তর করা সময়সাপেক্ষ ও জটিল হবে। পাশাপাশি, ঢাকাকেন্দ্রিক বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিকল্প সমাধান: প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার ওপর চাপ কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মন্ত্রণালয় ও সরকারি অফিস স্থানান্তর করা হলে ঢাকার চাপ অনেকটাই কমবে। উদাহরণস্বরূপ—
শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামে
কৃষি মন্ত্রণালয় রাজশাহীতে
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ময়মনসিংহে
আইটি ও প্রযুক্তি খাত সিলেটে
এভাবে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে প্রশাসনিক কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া হলে রাজধানী স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে আসবে।
উপসংহার
ঢাকার জনসংখ্যার চাপ কমাতে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া বা বিকেন্দ্রীকরণ—কোনটি বেশি কার্যকর হবে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। বিশাল ব্যয় ও সময়সাপেক্ষতার কারণে নতুন রাজধানী তৈরির পরিবর্তে বিকেন্দ্রীকরণ নীতি বাস্তবায়ন করাই হতে পারে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত সমাধান। এজন্য ঢাকার ওপর প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যার চাপ কমিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নে বিনিয়োগ করা জরুরি।