ময়মনসিংহে বছরের প্রথম দিন বই বিতরণের প্রস্তুতি চলছে। ১ জানুয়ারি সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করা হবে। তবে এবার প্রথম দিন চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাচ্ছে না। কারণ মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত এই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কোনও বই জেলার কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছানো যায়নি। ইতোমধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বেশিরভাগ পাঠ্যবই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে গেছে। ফলে এই তিন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই পাবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহে সরকারি-বেসরকারি মিলে সাড়ে তিন হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাড়ে সাত লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী দুই লাখ ৭১ হাজার ৭২৫ জন। বাকিরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির। তাদের বই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এলেও চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য কোনও বই আসেনি। ফলে বছরের প্রথম দিন এই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাচ্ছে না। এ নিয়ে কিছুটা মন খারাপ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের।
তবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বেশিরভাগ বই হাতে পেয়েছেন। সেগুলো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেগুলো চলে গেছে। ছাপার কাজে দেরি হওয়ায় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই আসেনি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চলে আসবে। হয়তো ৫ জানুয়ারির মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। সেটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দেশে উৎসব করে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয় ২০১০ সালে। তবে বিগত দুই-তিন বছর শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ১ জানুয়ারি উৎসব করে বই বিতরণ শুরু হলেও কিছু ক্ষেত্রে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব নতুন বই দেওয়া যায়নি। আসন্ন শিক্ষাবর্ষে উৎসব করে বই দেওয়া হবে না।
এবার বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত মোট পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৪০ কোটির বেশি। এসব পাঠ্যবই প্রণয়ন ও ছাপার কাজের দায়িত্ব জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, এবার প্রাক-প্রাথমিক পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৯ কোটি ৬৪ লাখের মতো। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ছাপা হয়েছে চার কোটি ৩৫ লাখের বেশি। তার মধ্যে তিন কোটি ৪৭ লাখের মতো বইয়ের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিকে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) মোট বইয়ের সংখ্যা ৩০ কোটি ৯৬ লাখের মতো। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত এক কোটি ৩২ লাখের মতো বইয়ের ছাড়পত্র হয়েছে।
ময়মনসিংহ নগরের নওমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফনান আহমেদ এবার চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধা তালিকায় ভালো ফল করে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। বছরের শেষ দিন মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) বিদ্যালয়ে এসে পরীক্ষার ফলের শিট হাতে পেয়ে দারুণ খুশি। তবে যখন শিক্ষকদের কাছে শুনেছে, বছরের প্রথম দিন নতুন বই পাবে না তখনই মন খারাপ হয়ে যায়।
বিশেষ সূত্রে জানা যায়, ‘এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি নতুন বই পেয়ে আসছি। তবে এবারই প্রথম, পঞ্চম শ্রেণিতে উঠার পর প্রথম দিন বই না পাওয়ার খবর শুনলাম। শিক্ষকদের কাছে বিষয়টি শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট শিট হাতে পেয়ে মন যেমন আনন্দে ভরে উঠেছিল, ঠিক তেমনই বই না পাওয়ার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেছে।’
একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার জানায়, ‘বছরের প্রথম দিন নতুন বই পাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। তবে এবার প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাবে। কিন্তু আমরা নতুন বই পাচ্ছি না। এটা আমাদের জন্য বেদনার। সবার জন্যই নতুন বইয়ের ব্যবস্থা করা হলে ভালো হতো।’
একই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শামীমা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলে আসিফ এবার চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। মঙ্গলবার বার্ষিক পরীক্ষার ফল দিয়েছে। ভালো ফল করেছে। তবে বিদ্যালয়ে ফল নিতে এসে জানতে পারলাম চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য কোনও বই আসেনি। এই খবর শুনে ছেলের মনটা বিষণ্ন হয়ে গেছে। প্রথম দিন বই না পেলে শিক্ষার্থীদের মন খারাপ হয়, পড়াশোনায় আগ্রহ কমে যায়। বিষয়টি দায়িত্বশীলদের ভাবা উচিত।’
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কোনও বই না আসায় কিছুটা মন খারাপ শিক্ষকদেরও। নওমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোকসানা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বেশিরভাগ বই এসেছে। তবে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কোনও বই আসেনি। বছরের প্রথম দিন তিন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া হবে, বাকিদের দিতে না পারা আমাদের জন্যও কিছুটা মন খারাপ হওয়ার মতো। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বই চলে আসবে। তখন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।’
এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই উল্লেখ করে রোকসানা আক্তার বলেন, ‘আসলে এবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন শিক্ষাক্রম কার্যত বাতিল হয়ে গেছে। এরপর এক যুগ আগে তৈরি পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। যার জন্য ছাপার কাজে দেরি হয়ে যায়। মূলত এসব কারণে বই পেতে দেরি হচ্ছে। তবে শিগগিরই আমরা বই পেয়ে যাবো।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে দুই হাজার ১৪০টি। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রায় দেড় হাজার। এর মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সাত লাখ ৪৬ হাজার ৮৩৭ জন। তার মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির এক লাখ ৪৪ হাজার ১৭২ এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী এক লাখ ২৭ হাজার ৫৫৩ জন। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির বই এলেও চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কোনও বই এখনও আসেনি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এসব বই আসবে বলে আশা কর্মকর্তাদের।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই পরিমার্জন করে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রক্রিয়ায় বই পরিমার্জন ও ছাপার কাজে কিছুটা দেরি হয়। যার ফলে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির বই এলেও চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই আসেনি। তবে কয়েক দিনের মধ্যে চলে আসবে। তখন সব শিক্ষার্থীকে বই দেওয়া হবে।’
অবশ্য এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান গত রবিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, বছরের প্রথম দিনেই সব শিক্ষার্থী অন্তত তিনটি করে বই পাবে। এর মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের কিছু বইও পাবে। ৫ জানুয়ারির মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির সব বই পৌঁছে যাবে। ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য তিনটি করে বই বছরের প্রথম দিনে যাবে। এসব শ্রেণির আরও পাঁচটি করে বই ১০ জানুয়ারির মধ্যে যাবে। বাকি বইগুলো ২০ জানুয়ারির মধ্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে যাবে।
তবে এনসিটিবি ও মুদ্রণকারী সূত্র বলছে, প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই ছাপায় অগ্রগতি ভালো। চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার অগ্রগতি খুবই কম। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জন, আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র দেওয়া, দেরি করে পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করাসহ ছাপাসংক্রান্ত কাজে বিলম্বের কারণে এবার এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।