ময়মনসিংহ জেলায় বিগত কয়েক বছরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। শহর ও আশপাশের অঞ্চলে অবকাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবহন ও প্রশাসনিক কাঠামো উন্নয়ন, সেবা সম্প্রসারণ এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনার আওতায় অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় হাজার একর জমি ও বসতভিটা। সড়ক সম্প্রসারণ, কেওয়াটখালি আর্চ স্টিল ব্রীজ, সংযোগ সড়ক, জেলা প্রশাসনের নতুন ভবন, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল প্রকল্পসহ বহু প্রকল্পের প্রয়োজনে এই ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে।
অধিগ্রহণ একটি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন, উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক মানুষের জীবনের রক্ত-ঘামে অর্জিত ভিটেমাটি, শতাব্দীর পুরোনো বসবাস, চাষাবাদ, পারিবারিক উত্তরাধিকার আর স্বপ্নের ঘর। এই জমি কারও দয়া বা দানের নয়; তাদের রক্ত, শ্রম আর জীবনের বিনিময়ে এই জমির মালিকানা এসেছে। অথচ এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় লাভবান হয়েছেন হাতে গোনা কিছু সুবিধাভোগী, আর অধিকাংশ সাধারণ মানুষ হয়েছেন সর্বস্ব হারানো বঞ্চিত শ্রেণি। অনেকেই গৃহহীন হয়ে পড়েছেন- পুনর্বাসন না করেই তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত উদাহরণ।
ভূমি অধিগ্রহণের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘন; আইনের চোখে ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ হলো; রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা উন্নয়নমূলক প্রয়োজনে ন্যায্য ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি রাষ্ট্রের আওতায় আনা। বাংলাদেশে ‘ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৭’ এই প্রক্রিয়ার মূল নিয়ন্ত্রক আইন। কিন্তু বাস্তবে ময়মনসিংহে যে ধরনের চিত্র দেখা যায়, তা এই আইনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যারা ভূমি দিয়েছেন, তাদের অনেকেই এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি। কেউ কেউ হয়রানির শিকার হয়ে ক্ষতিপূরণের দাবিতে বছরের পর বছর ঘুরছেন ভূমি অধিগ্রহণ অফিস আর জেলা প্রশাসনের বারান্দায়।
এইসব মানুষের ক্ষতিপূরণের টাকা দ্রুত প্রদান এবং তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এই দাবির পেছনে রয়েছে শত শত বাস্তব জীবনের কান্না, অপমান আর অস্তিত্বের প্রশ্ন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে দিনের পর দিন হেনস্তা, ভুল রেকর্ড, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য, এবং দায়িত্বহীনতা এসব মানুষকে ঠেলে দিয়েছে হতাশা আর অনিশ্চয়তার অতলে। উন্নয়নের চাকায় বলি হওয়া এই সাধারণ মানুষরা দিনের পর দিন ঘুরেও পাচ্ছেন না জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ভিটে-মাটির ক্ষতিপূরণ।
একটি সাক্ষাৎকার ও রাষ্ট্রের মুখোশ উন্মোচন; জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের এলএ (Land Acquisition) শাখার সামনে ছেঁড়া পাঞ্জাবি পড়া এক বয়স্ক লোক, যার চোখে শুধুই করুন কাতরতা আর অপমান। এলএ অফিসের কলাপসিবল গেইটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন। হাতে ধরা লাল রঙের একটি ফাইল; সাদা কাপড়ে বাঁধা। যেন এটি একটি সাধারণ নথি নয়, বরং রক্ত আর কাফনের ফরিয়াদ!
আমাকে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, এইনো ফারাবী স্যার কেডা? একটু দেহাইবাইন? আমারে ঢুকতে দেয় না! গেট তালা দিয়া রাহে! এই দেহুইন ফাইল, আমার জমিডা একুর অইছে!”
তাঁর মতো শত শত মানুষ প্রতিদিন এলএ অফিসের বারান্দায় এসে জমায়েত হন, কিন্তু তাঁদের জন্য দরজা খোলা থাকে না। অথচ এসব মানুষের জমি ছাড়া আজকের উন্নয়নের কোনও ভিত্তিই তৈরি হতো না।
নারী ও শিশু: সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী; ডানপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন কালো বোরখাওয়ালা নারী, হাতে ধরা পাঁচ বছরের একটি ছেলে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনে সম্বাদিক?” -স্বরে অসহায়তা।
“আমারে একটু সুমি মেডামের রুমটা দেহাইয়া দিবাইন? চর গোবিন্দপুর থাইক্য আইচি। হের বাপ মারা গেছে ২ বছর আগে। থাহার মধ্য আছিলো একখান টিনের ঘর আর সাথে এককাডা খেত। কয়দিন ধইরা ঘুরতাছি, স্যারে কইলো, আমরার কাগজপত্র সব ঠিক আছে, কিন্তু আমরার নাহি দকল নাই!”
এই নারীর মুখে দেশ ও রাষ্ট্রের কাছে হাজার প্রশ্ন; কেন একজন নিঃস্ব নারী সন্তানের মাথায় ছাদ দিতে পারছে না? কেন ‘সঠিক কাগজপত্র থাকার পরেও দখল অভিযোগে তাঁর অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরন তিনি পাচ্ছেন না, কেন?
প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রেকর্ড জটিলতা; ভূমি অধিগ্রহণে সবচেয়ে বড় সমস্যা রেকর্ড জটিলতা। এক সার্ভেয়ারের কাছ থেকে জানা গেল; “গতানুগতিক জমি রেকর্ড সংক্রান্ত জটিলতাই বেশী। তাছাড়া অধিগ্রহণ তালিকায় পরিসংখ্যানগত ভুল, মিসকেস, মামলা মোকদ্দমা এসব কারণে ক্ষতিপূরণ দিতে দেরি হয়।”
অনেক সময় অধিগ্রহণ তালিকায় কারও নাম না উঠলে কাগজপত্র সম্পূর্ণ থাকলেও সেই জমির ক্ষতিপূরণ আর পাওয়া যায় না। আবার অনেকক্ষেত্রে জরিপের ভুলে এক ব্যক্তির জমি আরেকজনের নামে চলে গেছে। এসব ভুল সংশোধন করতে বছরের পর বছর চলে যায়, ভুক্তভোগী সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেন।
জরিপের দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনা; আরেকজন ভুক্তভোগীর রসিকতা; করে বললেন; "কানে খাটো, বানানে অজ্ঞ, অংকে কাঁচা, এমনসব লোক দিয়া জরিপ করলে তো এমনডা অইবই! কস্ট তো আমরার, হেরার কি?"।
জরিপের ভুল, শ্রেণি বিভ্রান্তি, ও মৌজা মিল না থাকার কারণে বহু জমি অধিগ্রহণের আওতায় এলেও সঠিকভাবে তালিকায় আসেনি। জরিপের সময় ঘুষ ও রাজনৈতিক চাপেও অনেক প্রকৃত মালিককে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ক্ষতিপূরণ নয়, চাই পুনর্বাসন; ভূমি অধিগ্রহণ একটি এককালীন ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় না। কেউ যদি তার বসতভিটা হারায়, তার জন্য শুধু টাকার ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট নয়। তাকে পুনর্বাসনের অধিকার দিতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ময়মনসিংহে কোনো পুনর্বাসন পরিকল্পনার খবর পাওয়া যায়নি। যে ভূমি নেওয়া হচ্ছে, তার বিনিময়ে কোথাও কোনো সরকারি আশ্রয়ন বা পুনর্বাসন প্রকল্প গড়ে ওঠেনি।
অনেকে সরকারি অর্থ পেয়েও একসঙ্গে বাসযোগ্য জমি বা ঘর কেনার সুযোগ পাননি। যাদের বসবাস ছিল শহরতলির কাছাকাছি, তারা এখন আশ্রয় নিচ্ছেন দূরের কোন গ্রামে; যেখানে জীবনধারণ আরও কঠিন। শিশুরা স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে, নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, এবং বৃদ্ধরা চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে মরছেন।
সমাধানের পথ কী?
এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হলে একাধিক স্তরে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
প্রথমত, ডিজিটাল রেকর্ড ও স্বচ্ছ জরিপ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জমির শ্রেণি, মালিকানা, দখলদারিত্ব যাচাইয়ে ড্রোন ও স্যাটেলাইটভিত্তিক ম্যাপিংকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, একটি পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নীতি তৈরি করতে হবে। ভূমি অধিগ্রহণের আইনকানুন যথাযথভাবে মানতে হবে। ৪ধারা, ৭ ধারা, ৮ ধারা এসব ধারার কার্যক্রম সম্পর্কে ভুক্তভোগীদের অবহিত করতে হবে। অধিগ্রহণে শুধু টাকার ক্ষতিপূরণ নয়; ঘর, কাজের সুযোগ, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে।
তৃতীয়ত, ভূমি অধিগ্রহণ অফিসে গণশুনানি ও অভিযোগ সেল চালু করে সরাসরি ভুক্তভোগীদের অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মানবাধিকার সংগঠন ও সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্ত করে এই সেল পরিচালিত হতে পারে।
চতুর্থত, ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যারা এলএ অফিস, জরিপ বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে।
সবচেয়ে জরুরি হলো; মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যে রাষ্ট্র গরিবের জমি অধিগ্রহণ করে কিন্তু তাকে ঘর দিতে পারে না, সে রাষ্ট্র উন্নয়নবান্ধব নয়, তা নিপীড়নমূলক। উন্নয়ন তখনই সার্থক, যখন তা সর্বস্তরের মানুষের মুখে হাসি ফোটায়।
ময়মনসিংহে ভূমি অধিগ্রহণের নামে উন্নয়নের নামে যে গৃহহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে, তা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার প্রশ্ন। রাষ্ট্রের কাজ শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়, বরং প্রতিটি মানুষের অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজন থাকলেও, তা যেন কোনো মানুষকে কাঁদিয়ে না হয়।
আজ সময় এসেছে এই কান্নার ফাইলগুলো খুলে দেখার। কারণ প্রতিটি লাল ফাইলে শুধু জমির নথি নেই; আছে রক্ত, ঘাম আর এক টুকরো স্বাধীন জীবনের ইতিহাস। এই ইতিহাস যেন আর কারও কাছে কাফনের ফরিয়াদ না হয়।